সালমা বেগম বিয়ের এক বছরের মধ্যেই এক পুত্র সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করেন।
সালমা বেগমের স্বামী লতিফ সরকার ছোটখাট একটা সরকারী চাকুরী করতেন।হঠাৎ স্ত্রী বিয়োগে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন।সাংসারিক অবস্থাও খুব একটা ভাল ছিল না।সংসারে তার মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। মায়েরও বয়স হয়েছে। নিজের কাজ নিজেই করতে পারেন না।তার উপর আবার ছোট বাচ্চা ? কে দেখবে এই বাচ্চাটাকে? সংসারই বা কে দেখবে?
ভেবে ভেবে অস্থির লতিফ সরকারের মা।
লতিফ সরকারের মাতৃভক্তির তুলনা নাই।মাও তার ছেলের জন্য অস্থির।দেখতে দেখতে সংসারে নেমে আসল এক প্রচন্ড ঝড়।
শিশুটি তার মায়ের মমত্বের পরশ তো পেলই না বরং পৃথিবীর বুকে পদার্পণই হলো তার জন্য অভিষাপ সরূপ।
মানুষের জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ট লাঘব করে দেয় হচ্ছে আমাদের মা। মাতৃস্নেহ পৃথিবীর সবকিছুর ঊর্ধ্বে। নিজের সুখ হারাম করে সন্তানকে মানুষ করার, প্রতিষ্ঠিত করার সার্বক্ষণিক চেষ্টা থাকে মায়ের। মা-ই নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না সন্তানের জীবন রক্ষায়।
পৃথিবীর সব দেশের শিশুর প্রথম ভাষা হচ্ছে 'মা'।
কিন্তু এই শিশু জম্মের পর থেকেই সেইসব থেকে বঞ্চিত।
লতিফ সরকারের মা শিশুটির নাম রাখলেন জয়।তিনি ছেলেকে দেখে শুনে আরেকটি বিয়ে করতে বললেন।
লতিফ সরকার পাশের গ্রামের সেলিম মিঞার মেয়ে জরিনাকে বিয়ে করলেন।বিয়ের দুই বৎসর পর ঘর আলো করে জরিনা বেগম একজন পুত্র সন্তান জম্ম দেন।তার নাম রাখলেন সুজন।
জয় এবং সুজন বড় হতে লাগল।তাদের স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হল।দুই ভাইয়ের খুব মিল।ওরা জানতো না যে তারা সৎ ভাই।কিছুনদিন পর লতিফ সরকারের মা মারা গেলেন। সংসারে দুই সন্তান , স্বামী-স্ত্রী মিলে ভালই কাটছিলো।
জয় এবং সুজন দুইজনই তার মাকে খুব ভালবাসতো।মা জরিনা দুই ছেলেকেই সমান চোখে দেখতেন।মা যেন তাদের নয়নের মনি।মা শব্দটি তাদের কাছে খুবই প্রিয়।
মায়ের চেয়ে বহুল উচ্চারিত শব্দ আর নেই। জন্মের পর, চোখ খোলার পর যে মানুষটিকে প্রথম দেখে শিশু, সেই মানুষটি মা। পৃথিবীর যে কোনো দেশে যে কোনো ভাষায় শিশু প্রথম উচ্চারণ করে ‘ম’ শব্দটি। ‘ম’ থেকেই মা শব্দটি এসেছে।
কিন্তু জয় এসব ভালবাসা কিছুই পেল না।এমনকি তার গর্ভধারিনী মাকেও চিনলো না।
কোন লেখনী বা কলমের কালি দিয়ে মায়ের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধাকে পরিমাপ করিতে পারে না। পৃথিবী জুড়ে আছেন একজন, তিনি হচ্ছেন আমাদের মা। সন্তান জন্ম দিতে মাকে কতটুকু কষ্ট সহ্য করতে হয় সেটা শুধু একমাত্র মা’ই জানেন। মানুষের ব্যথা পরিমাপ করার জন্য বিজ্ঞান যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানই বলে, মানুষ সর্বোচ্চ ৪৫ ডেল (ব্যথা পরিমাপের একক) ব্যথা সহ্য করতে পারে। কিন্তু একজন মা যখন সন্তান প্রসব করেন তখন তিনি ৫৭ ডেল ব্যথা সহ্য করেন; যা একই সময়ে ২০টি হাড় ভেঙে ফেলার সমান। সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে মাকে এরকমই কষ্ট করতে হয় । কোন সন্তানই মায়ের প্রসব ব্যথার যন্ত্রনা বুঝতে পারে না। যদি বুঝতে পারত তবে কোন সন্তানই তার মাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতো না।
জয় এবং সুজন স্কুলে লেখাপড়া করছে। ছাত্র হিসাবে জয়ের থেকে সুজনই ভাল ছিল। প্রত্যেক ক্লাসেই সুজন প্রথম স্থান অধিকার করত।কিন্তু জয় লেখাপড়ায় খুব একটা ভাল না হলেও আদব কায়দায় খুবই ভাল ছিল। মা কে সুজনের থেকেও বেশী শ্রদ্ধা ভক্তি করত জয়।
একদিন রাস্তায় দুর্ঘটনায় লতিফ সরকার সাহেব মৃত্যুবরণ করেন। পরিবারে নেমে আসে বিপর্যয় । এতে জরিনা বেগম ভেঙ্গে পরেন।
তবুও সংসারের হাল শক্ত হাতে ধরে রাখেন জরিনা। ছেলে দুইটাকে মানুষের মত মানুষ করার অঙ্গীকার নিয়ে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ন হন।পেনশনের কয়েকটি টাকা দিয়ে নিজেদের খরচ ও ছেলেদের লেখাপড়া র খরচ চালানো খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে।
জরিনার একচোখ অন্ধ ছিল এবং দেখতেও খুব একটা ভাল ছিলেন না ।
মাঝে মাঝে জরিনা ছেলেদের টিফিন নিয়ে স্কুলে যেতেন। কিন্তু জয় কিছু না বললেও সুজন তা পছন্দ করতো না। সুজন চাইতো না যে তার অন্ধ কুৎসিত মা সবার সামনে আসুক।কিন্তু মা তা মানতেন না বা বুঝতেন না বা বুঝার চেষ্টাও করেন নাই কখনো।
স্কুলের অন্যান্য ছাত্ররা সুজনকে তিরস্কার করতো তার মা দেখতে অসুন্দর এবং অন্ধ বলে। এর ফলে সুজন খুব লজ্জাবোধ করতো। মা যাতে স্কুলে না আসেন সুজন তাই চাইতো। এভাবে ধীরে ধীরে মায়ের প্রতি সুজনের ঘৃণা জন্মাতে থাকে।কালে তা প্রকট আকার ধারন করে।কিন্তু জয়ের মধ্যে এমন হীনমনতা ছিল না।
মায়ের স্নেহ- ভালবাসার পরিধি ও গভীরতা পরিমাপ করা যায় না। মা উচ্চারণের সাথে সাথে হূদয়ের অতল গহীনে যে আবেগ ও অনুভূতি রচিত হয় তাতে অনাবিল সুখের প্রশান্তি নেমে আসে। কাজেই, মা হচ্ছেন মমতা-নিরাপত্তা-অস্তিত্ব, নিশ্চয়তা ও আশ্রয়স্থল। মা সন্তানের অভিভাবক, পরিচালক, দিক-নির্দেশক, ও একজন ভাল বন্ধু। যাঁর ভালবাসার কোন সীমানা নেই।
একথাগুলো জয় বুঝতো কিন্তু সুজন মোটেই বুঝতো না।
তুলনাহীন এক সম্পর্কের নামই হলো মা। তাই পৃথিবী সৃষ্টির পর মানুষ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মাকে দেয়া হয়েছে এমন এক আসন। যে আসনটি সন্তানের কাছে স্বর্গীয় সুখের সাথে তুলনীয়। শৈশবের মায়ের কোল, মাতৃশাসন, মাতৃস্নেহ সবকিছুতেই যে রয়েছে এক অতুলনীয় প্রতিবিম্ব, যা আর কিছুতে নেই। সন্তানের যে কোন প্রয়োজনে মা-ই হয়ে ওঠেন সব থেকে বড় অবলম্বন। অজান্তেই যেন সন্তানের বিশেষ মুহূর্তে মায়ের মুখটিই সবার আগে মনে পড়ে। মা সন্তানের জীবনে এমন এক অস্তিত্ব ধারণ করে আছে। বাস্তবিক অর্থে তাই সন্তান জীবনের প্রতিটি স্তবকে এসে নিবিড়ভাবে অনুভব হয় মায়ের উপস্থিতি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে মাকে। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সূচনা থেকেই মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ীর সম্পর্ক রচনা করে দিয়েছেন। তার আর অন্য কোন দৃশ্যপট নেই। সন্তানের কাছে তাই মা হলো আনন্দ-বেদনার সর্বশেষ অংশীদার। ইসলাম সন্তানের ওপর পিতা অপেক্ষা মাতার অধিকার বেশি রেখেছে। কেননা নবজাত শিশুর লালন-পালনের জন্য মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কষ্ট তুলনাহীন।
কিন্তু সুজনের মাঝে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে। এর একটি বাক্যও সুজনকে বশ করতে পারেনি কোনদিন।
সুজন স্কুল,কলেজ থেকে সুনামের সাথে পাশ করে উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার জন্য বিদেশে যাওয়ার কথা মা-কে জানালো।অবশেষে সুজন উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় বিদেশে পাড়ি জমালো।
সুজনের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে জরিনা হিমসীম খেতে লাগল।
“ চিন্তা করো না মা, আমি রোজগার করে সুজনের লেখাপড়ার জন্য টাকা পাঠাব।” মাকে বলল জয়।
“ না বাবা তুইও লেখাপড়া কর।প্রয়োজনে আমি দর্জির কাজ করব। আর পেনশনের টাকা তো আছেই। না হয় আরও কষ্ট করব। তাও তোরা লেখাপড়া কর।” বললেন জরিনা।
জয় স্কুলের সীমানা আর পেরুতে পারল না।সুজনের লেখাপড়ার টাকার জন্য সে তার মায়ের সাথেই গ্রামে থেকে জমিজমা চাষ করতে লাগল ।
অনেকদিন হলো সুজন বাড়ী আসে না। মা জরিনার মন ছটফট করছে। এক স্বামীহারা মহিলা তার সন্তানদের অনেক কষ্ট করে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন।
সুজনকে অনেক কষ্ট করে টাকা পাঠান জরিনা।কিন্তু সুজন মায়ের সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না।
সুজন লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে একটা চাকুরীও পায় এবং বিয়েও করে। দেশে ফিরে আসার পর চাকুরী এবং বিয়ে করার বিষয়টি তার মা কে জানায় না। ভায়ের সাথেও কোন যোগাযোগ রাখে না। যে ভাই নিজের লেখাপড়াকে বিসর্জন দিয়ে কষ্টকরে চাষাবাদ করে টাকা রোজগার করে ভাই সুজনকে পড়াইয়েছে।আজ সেও হলো পর।
সুজন দেশে ফিরলেও জরিনা সুজনের কোন ঠিকানা জানতেন না।লেখাপড়া করার সময় যখন টাকা লাগত তখন বিদেশ থেকে সুজন যোগাযোগ করত মা জরিনার সাথে। কিন্তু মা জরিনা জানতেন সুজন লেখাপড়া শেষ করে কবে নাগাদ দেশে ফিরবে।কেশ কিছুদিন হয় সুজন আর টাকাও চায় না এবং যোগাযোগ ও রাখে না।
তাই সুজনের মা ধরেই নিয়েছিলেন যে ছেলে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে এসেছে।
সুজনের স্ত্রীর এক সন্তান হয়। তাদের নিয়ে সুজন বেশ সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। মায়ের কোন খোঁজ খবর রাখে না। জানেও না যে, তার মা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছেন।মা এবং ভাই জয় এর সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন টুকু এখন বোধ করে না সুজন।এমন নিষ্ঠুর হয়েছে সুজন।
কিন্তু মায়ের মন সবসময় সুজনের জন্য কাঁদে।
অনেকদিন পর সুজনের মা অনেক কষ্ট করে সুজনের ঠিকানা যোগাড় করেন এবং সেই ঠিকানা মোতাবেক জয়কে সাথে নিয়ে সেখানে যান। জরিনা যখন সুজনের বাসায় দরজা নক করেন, তখন সুজনের স্ত্রী এসে দরজা খুলে দেয় ।সংগে জরিনার নাতীও ছিল। তারা হাসাহাসি করতে থাকে জীর্ণ শীর্ণ পোশাক আর অন্ধ দেখে।স্ত্রী বলে মাপ করো।ভিক্ষা দিতে পারবো না। এমন সময় সুজন বাহিরে এসে তার মাকে দেখে অগ্নিশর্মা রূপ ধারণ করে তিরস্কার করে বলে,তুমি এখানে আসছো কেন? চলে যাও এখান থেকে?
“যাব বাবা,আমি একটু তোকে দেখতে এসেছি,অনেকদিন তোকে দেখি না তো তাই। ভাল আছিস তো বাবা সুমন।“ মা বললেন।
এই কথা বলে সুজনের মা যেই মাত্র হাত বড়িয়ে আদর করতে গেছে, অমনি সুজন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মাকে। পড়ে গিয়ে কপাল কেটে দরদর করে রক্ত বের হতে লাগলো।
“ তুমি চেনো নাকি ঐ ফকির টাকে?“সুমনের স্ত্রী বলল।
এতে মা খুব কষ্ট পায় ।তবুও বলে রাগ করিস কেন বাবা,আমি তো তোকে দেখতে এসেছিলাম। কিছুতো চাইতে আসেনি।
জয় আর রাগ সামলাতে না পেরে চট করে একটা চড় মারে সুজনের গালে।জয় যেহেতু সম্পর্কে বড়,সেইহেতু বিষয়টা খুব একটা অতুক্তি ছিলনা। আর জয় বলতে থাকে, “ যাকে তুমি আজ তিরস্কার করছো ,ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে বলছো তিনি কিন্তু তোমাকে এই পৃথিবীর আলো দেখাইয়াছে।তিনিই তোমাকে কষ্ট করে মানুষের মত মানুষ করেছেন। তিনি তোমাকে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন কি তোমার তিরস্কার পাবার বা গলা ধাক্কা দেবার জন্য?
কুসন্তান হলেও সন্তানের বিপদে মা নিজের জীবন দিয়েও তার প্রতিদান দেন। এমন মাকেও যারা কষ্ট দেয় তারা সত্যিই অমানুষ । স্ত্রীর প্ররোচনায় হোক কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, মাকে অনেকেই কষ্ট দিয়ে থাকে। হাল আমলে ঝামেলা মনে করে অনেকেই বাবা-মাকে বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। কিন্তু যারা এ কাজ করে, তারা কখনও কি ভেবে দেখেছে,_ তারাও একদিন বৃদ্ধ হবে, তারাও মা-বাবা হবেন?তাদের নিয়তিতেও যে এমন কিছু লেখা নেই , তার নিশ্চয়তা কি? মা তো মা-ই। সন্তানের খারাপ আচরণেও মা পরম মমতায় ক্ষমা করে দিতে পারেন।
মায়ের কাছে সকল সন্তানই প্রিয় সন্তান। কারো কখনোই মায়ের অবাধ্য হওয়া উচিত নয়। অবাধ্য সন্তান মায়ের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কৃতী সন্তান মায়ের কাছে মাথার মুকুটস্বরূপ। যে সন্তান মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত, তারা জীবনে সাফল্য লাভ করে। বৃদ্ধ অবস্থায় "মা" সন্তানের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় অসুখ ও স্বাস্থ্যের প্রতি অধিক নজর দিতে হয়,যা সকল সন্তানদেরই কর্তব্য । তাঁর সেবা-শুশ্রষার প্রতি যত্নশীল হওয়া সন্তান হিসাবে কি কোনই কর্তব্য নেই? একটি অপূর্ব উক্তি যা না বললেই নয়— মাকে স্মরণ করে জগদ্বিখ্যাত মনীষী আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, 'আমি যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু হয়েছি অথবা যা হতে আশা করি তার জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী।'তুমি এখন ভাব তুমি এমন আচারণ করে ঠিক করেছো কি-না।“
“থাক বাবা আর বলিস্ না,সুজন ভাল থাক্, সুখে থাক্।চল এবার আমরা বাড়ী ফিরে যাই।“ জয়কে বলল মা।
“ কেন বলব না মা? আমি তোমার সৎ ছেলে। আমি কি কখনো সুজনের মত আচারণ করেছি?তোমার মনে কষ্ট দিয়াছি?সুজন আজ বেশী শিক্ষিত হয়েও তোমাকে কেন অপমান করছে?তুমি এসেছিলে তোমার সন্তান কেমন সুখে আছে শুধু দেখতে। কিছু তো চাইতে আসোনি।“ বলল জয়।
সুজন একটি কথাও বলছে না । চুপ করে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।স্ত্রী-সন্তানের সামনে হঠাৎ মার খেয়ে নিজের বিবেক কেমন জানি নাড়া দিচ্ছে।
“ চল বাবা। সুজনকে একনজর দেখেছি তো? তাতেই আমার মন ভরে গিয়াছে। ওরা কেমন আছে তাই দেখতেই তো আমার আসা। “মা বললেন।
এরপর চলে যায় তারা নিজেদের বাড়ীর ঠিকানায়।
এর বেশ কিছুদিন পর সুজন বিবেকের তাড়নায় তার জন্মভুমিতে মায়ের গ্রামের বাড়ীতে যায়। কিন্তু হায়! নিয়তির নির্মম পরিহাস ।কে খন্ডাতে পারে?
সুজন বাড়ী গিয়ে মা মা বলে বাড়ীর ভিতরে ঢুকে পড়ে।
জয় এসে তাকে জানালো যে কিছুদিন আগে তাদের মা মারা গেছেন। তোমাকে একটা চিঠি লিখে গেছেন।
সুজন সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়ে আর অনুশোচনা করতে থাকে ।
চিঠিতে লেখা ছিল-
খোকা,
" তোমার বাসায় গিয়েছিলাম তুমি কেমন সুখে আছো সেটা দেখতে। আমার খুব ভাল লেগেছিল যে, তুমি ভালো আছো। আমার মনে আর কোন দুঃখ নেই। তবে খোকা, তোমাকে একটা কথা আমি জানানো প্রয়োজন মনে করছি,যা তুমি হয়ত আজও জানো কিনা জানিনা। তোমার জন্মের পর একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি আমার একটা চোখ দিয়ে তোমার দু‘নয়নে আলো দেখাইয়াছিলাম। সেদিন আমার খুব ভাল লেগেছিলো, আমার একটা চোখ দিয়ে হলেও তুমি তোমার দুই চোখ দিয়েই এই সুন্দর পৃথিবীটাকে উপভোগ করতে পারছো। এটাই আমার বড় আনন্দ। আর একটি কথা, তোমার বড়ভাই জয় কিন্তু তোমার সৎ ভাই । সে নিজের লেখাপড়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে দিনরাত্রি পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করে তোমাকে পড়ায়ে মানুষের মত মানুষ করার জন্য আমাকে সার্বক্ষণিক সহযোগীতা করেছে।আর আমাকে যে মাতৃভক্তি দেখিয়াছে তার তুলনা হয়না। আমাকে সবসময় জয় তার একটি চক্ষু দিয়ে আমার চোখটা ভাল করার কথা বলতো। ওর প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করিও। দোয়া রইল।"
চিঠিটা পড়ে সুজন হাও-মাও করে কেঁদে উঠে, আর বলে “মা আমার মা, তুমি আমাকে ক্ষমা কর মা ।বেঁচে থাকতে তোমায় আমি চিনলাম না মা।পৃথিবীতে আর যেন কোন মানুষ আমার মত এমন অমানুষ না হয়।“
আসুন আজ আমরা সবাই আমাদের মাকে অন্ততঃ একবার বলি, "মা আমার মমত্বময়ী মা,আমি তোমায় ভালবাসি।মায়ের ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়।“
সুজনের হাঁওমাঁও করে কান্নাকাটি আর আহাজারী শুনে আশেপাশের লোকজন ছুটে আসে।
গ্রামের কয়েক জন মাতব্বর শ্রেণীর লোক এসেও হাজির হয় সুজনদের বাড়ীতে।একজন মতব্বর সুজনকে বলেন যে, তুমি বড্ড দেরী করে ফেলেছো।তুমি লেখাপড়া শিখেও মায়ের মর্ম বুঝলে না,এমন কি মাকে কাছে টেনে নিতে পারোনি। সাড়াজীবন উনি কষ্ট করেই গেলেন। তুমি সন্তান হয়েও কি তাঁকে একটু হলেও সুখ দিতে পারলে না? জয় যদি এখানে না থাকতো,তবে তোমার মাকে কে দেখতো?
পৃথিবীর সব দেশে, সব জায়গায় সন্তানের কাছে অত্যন্ত কাছের মানুষটি হলেন মা। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই সন্তান দেখে ফেলে মায়ের প্রিয়, মানবিক দরদভরা মুখটি। যে মুখের ক্যানভাসে আঁকা হয়ে আছে সন্তানের জন্য রাজ্যের যত কল্যাণকর শুভ কামনা, দোয়া, আশীর্বাদ, ভালবাসা।
সন্তান জন্মের সূচনাপর্ব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মায়ের অবদান অতুলনীয়।
তোমার জম্মের পর থেকে এর কোনটিরই তোমার জন্য কমতি ছিল না।কিন্তু তুমি তা গ্রহন না করে পদদলিত করেছো।
সন্তানকে সুস্থ ও সৎমানুষ রূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মায়েদের আজীবন সাধনাকে অম্লান করতে রাসুলুল্লাহ(সা.)-
এর মুখনিঃসৃত বাণীতে ঘোষিত হয়েছে, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেস্ত ।’
মায়ের গর্ভকালীন কষ্টের কথা আল্লাহ তাআলা ব্যক্ত করেছেন, ‘আর আমি মানুষকে তার পিতামাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি, তার মা তাকে কষ্টের ওপর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে, সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৪) ।
হৃদয়ের সবটা জুড়েই থাকে মোদের প্রিয় মা। হৃদস্পন্দনের প্রতিটি স্পন্দনে যে শব্দের ঝংকারময় আবেগ আর আকুলতা নিয়ে গুঞ্জরিত হয় সে শব্দটি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর। সব থেকে কাছের এবং সবচেয়ে প্রিয় আশ্রয়স্থল আর এক বিশাল ছায়ার নাম হলো মা। মা-এর সঙ্গে কোন কিছুরই তুলনা হয় না। মা মানেই অন্য এক জগত। অন্য এক জীবন। যে জীবনে মায়ের কোন বিকল্প নেই। জন্ম থেকে জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে মায়ের অবস্থান সন্তানের কাছে অসীম মূল্যবান।
যা তুমি পাওনি। জয় সৎ সন্তান হলেও মাতৃস্নেহে বড় হয়েছে।তার অবদান দিয়েছে। এতে কারো দ্বিধা নেই। কিন্তু তুমি তোমার মায়ের গর্ভের ছেলে হয়েও মায়ের জন্য কিছু করতে পারলে না।
আল্লাহ্ তালা ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তাঁর শরিক করবে না এবং পিতামাতার প্রতি উত্তম ব্যবহার করবে।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-৩৬)
সন্তানের গোটা জীবনই হচ্ছে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের সময়, এমনকি মায়ের মৃত্যুর পরও সন্তানের এ দায়িত্ব কখনো শেষ হয় না। মানব সন্তানেরা মায়ের ত্যাগের কথা বেমালুম ভুলে সত্য অস্বীকার করে বলেই বিশ্বজুড়ে গৃহে বা বৃদ্ধাশ্রমে মায়ের প্রতি বঞ্চনা, অবহেলা আর অবজ্ঞার বার্তা শোনা যায়। প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে মায়ের প্রতি অসদাচরণ ও অবহেলা করে বহু সন্তান বিপথগামী বা ভর্ৎসনার পাত্রও হয়েছে।
পৃথিবীর যাবতীয় ভালো লাগাটাও যেন মা সন্তানের জন্যেই তুলে রাখেন পরম যত্নে।
মুসলিম পরিবারে সন্তানের মা সব সদস্যের কাছ থেকে সম্মানজনক মর্যাদা ও সদাচরণ পাওয়ার দাবিদার। সন্তান জন্মের সূচনাপর্ব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মায়ের অবদান অতুলনীয়। তাই মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিনয়, সদাচরণ এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের বাণী পবিত্র কোরআনে যথাযথ ও সুবাচনিক ভঙ্গিতে বিধৃত হয়েছে।
যাদের মা আজ বেঁচে নেই, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য সম্পদটিই হারিয়েছে। জন্মান্তরের বাঁধন ছিঁড়ে মা আজ স্রষ্টার সান্নিধ্যে। পৃথিবীর সবাই ভালোবাসার প্রতিদান চায় এমনকি নিজের স্ত্রী সন্তানরাও। কিন্তু একমাত্র মা-ই, পারেন কোনো প্রতিদানের আশা না করেই সন্তানকে ভালোবাসতে।
মায়ের অভাব সুজন বুঝতে পারল যখন মাকে সারাজীবনের জন্য হারালো। যদিও যান্ত্রিক ব্যস্ততম পৃথিবীতে অনেকেরই এখনও মায়ে প্রতি কর্তব্যবোধ আসেনি।
একজন মায়ের কাছে পৃথিবীর সকল সন্তানই তার আপন সন্তান। অনেক ভুল, অনেক অপরাধ জেনে হোক বা না জেনে হোক, হয়তো করে ফেলে সন্তানেরা। মা, দয়ার সাগর। সন্তান যখন মায়ের সামনে অপরাধ স্বীকার করে দাঁড়ায়, তখন সকল মায়ের হৃদয়ই নরম হয়। আপন মহিমায় মা সকলকে ক্ষমা করে দেন।
তাই কবিতার ভাষায় মায়ের মনের কিছু কথা তুলে ধরলাম:
যখন তোমার কেও ছিল না তখন ছিলেন মা
এখন তোমার সব হয়েছে,আমায় চিনো না।
তোমার দু:খে দুখী আমি চিরদিনই ছিলাম
এখন ক্যানো তোমার কাছে পর হয়ে গেলাম।
তবুও ভাল থেকো খোকা আমার,চিন্তা করো না
তোমার সুখে সুখী হবো পেলেও যন্ত্রণা।
মা কি জিনিস এটা যদি বুঝতে তুমি পারো
জীবনে কষ্ট হবে না সুখী হবে আরো।